ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ
স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ
ওয়াহিদা আক্তার
‘ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ- স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৬-৮ জুন জাতীয় ফলমেলা ২০২৪ এর আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত সময়োপযোগী, যা জনগণের পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের মাটি উর্বর ও জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি । আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উষ্ণম-লীয় ও উপ-উষ্ণম-লীয় ফল চাষ হচ্ছে। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থসামাজিক ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের ফল স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে ও পুষ্টিমানে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময়। ফলদবৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রধান উৎস হিসাবে কাজ করে। তাছাড়া ফলের ভেষজ গুণাবলিও অনেক। আমাদের খাদ্য, পুষ্টি, ভিটামিনের চাহিদাপূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধে ফলের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ফল শিল্পের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ে তুলতে কৃষিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশের কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উন্নয়নশীল দেশটিতে এখন ১৭ কোটিরও বেশি লোকের বসবাস। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমির বিপরীতমুখী চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যশস্য উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। ফলের উৎপাদনও সমানতালে এগিয়ে চলছে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে নবম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এই দেশের প্রধানফল। এখন বাংলাদেশে প্রায় ৭০-৮০ রকমের প্রচলিত, অপ্রচলিত ও বিদেশি ফল উৎপাদন হয়ে থাকে।
জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি)-২ তে উল্লেখ আছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মান উন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। টেকসই উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করা। খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন। তাই নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সাধারণত ফল গাছ লাগানোর ২-৪ বছর পর ফল পাওয়া যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ১৪৩.৩১২ লাখ মেট্রিক টন। এ বছর ২০২২-২৩ সালে সেই লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের ১৫০.৩৩ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২৭ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নাটোর, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে অধিকাংশ আমের ফলন হয়। লিচুর আবাদ হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। অধিকাংশ লিচুর ফলন হয় রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলায়। কাঁঠালের আবাদ হয়েছে ৫৮ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে ও সম্ভাব্য উৎপাদন ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়। অন্যদিকে, আনারসের আবাদ হয়েছে ২০ হাজার ২৮ হেক্টর জমিতে ও সম্ভাব্য উৎপাদন ৫ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। আনারসের সিংহভাগ উৎপাদন হয় টাঙ্গাইলে। চলতি বছর (২০২৩-২৪) বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধিসহ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশি¬ষ্ট হর্টিকালচার উইং বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছেন।
একটি সুস্থ ও উৎপাদনশীল জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য পর্যাপ্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যক। ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ফলের পুষ্টিগত উপাদান ফলের প্রকৃতি, পরিপক্বতা, উৎপাদন কৌশল, সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়া আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে ফল রান্না ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুরো ভিটামিন ও খনিজ লবণই অটুট থাকে এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় উলে¬খযোগ্য ভূমিকা পালন করে। টাটকা ফলের প্রধান অংশ হচ্ছে পানি (৮০-৯৫%)। ফলে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট তুলনামূলকভাবে কম থাকে, দ্রবণীয় শর্করা ও পেকটিন বাদে ফলের পুষ্টিমান প্রধানত খনিজ ও ভিটামিনের ওপর নির্ভরশীল, এজন্য ফলকে দেহ রক্ষাকারী খাদ্য বলা হয়।
খাদ্যের সহজলভ্যতা, মূল্যস্তর এবং খাদ্যাভ্যাসের ওপর খাদ্যসামগ্রীর ব্যবহার নির্ভরশীল। বর্তমানে জনগণের পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে। ফল গ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন প্রায় ১০০-২০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। ঐঙটঝঊঐঙখউ ওঘঈঙগঊ অঘউ ঊঢচঊঘউওঞটজঊ ঝটজঠঊ (ঐওঊঝ-২০২২) তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের মানুষের দানাজাতীয় শস্য গ্রহণের পরিমাণ গত এক যুগে প্রতিদিন মাথাপিছু প্রায় ৪৪২ গ্রাম থেকে নেমে এসেছে ৩৫২ গ্রামে, আবার ফল গ্রহণের পরিমাণ প্রতিদিন মাথাপিছু ৪৪.৭ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৫.৪ গ্রাম, যা ইতিবাচক।
নিবিড় ফল চাষে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ফলের উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত শ্রমঘন কাজ বিধায় এগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। অপরপক্ষে ফলের গড় ফলন দানাদার খাদ্যশস্য অপেক্ষা অনেক বেশি। এছাড়া ফলের মূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আয়ও অনেক বেশি হয়। উদাহরণস্বরূপ এক হেক্টর জমিতে ধান, গম চাষে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ সমপরিমাণ জমিতে কলা ও আম চাষ করে যথাক্রমে ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা আয় হয়।
বাংলাদেশ এখন খোরপোশ কৃষি থেকে রপ্তানিমুখী বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ফল বিশ্ব বাণিজ্যে অবদান রেখে চলছে। বিদেশে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলের প্রচুর চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সীমিত আকারে টাটকা ফল রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত উলে¬খযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে কাঁঠাল, আম, আনারস, লেবু, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, তেঁতুল, চালতা উল্লেখযোগ্য। টাটকা ফল ছাড়াও হিমায়িত ফল (সাতকরা, কাঁঠালবীজ, কাঁচকলা, লেবু, জলপাই, আমড়া ইত্যাদি) ইতালি, জার্মানি, সৌদিআরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও বাহরাইনে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের সূত্র অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে আম রফতানির পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে উৎপাদিত ৭২টি জাতের মধ্যে ৮-৯টি জাতের আম রফতানি হচ্ছে।
বাংলাদশে রপ্তানি ব্যুরো তথ্য মতে, ২০২২-২৩ র্অথবছরে ফলমূল রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়াও ফলের রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) মেনে উৎপাদন, ফল সংগ্রহোত্তর ব্যবপনায় কৃাষ যান্ত্রিকীকরণ, রপ্তানি উপযোগী জাতের ব্যবহার, আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবের মাধ্যমে নানা কাজ চলমান আছে।
আমরা এখন স্মার্ট কৃষির যুগে প্রবেশ করছি। স্মার্ট টেকনোলজি কৃষিকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলবে দিনে দিনে। ফল চাষে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এসব কিছুর সুবিধা কৃষকপর্যায়ে চলে আসার সাথে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের চাহিদার সাথে তালমিলিয়ে বাংলাদেশের ফল বিশ্ব বাজারে শক্তিশালী অবস্থান করে নেবে।
জাতীয় ফলমেলা ২০২৪ কে সফল করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সেমিনার, মেলা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে আপামর জনসাধারণ বিভিন্ন ফলের চাষ সম্প্রসারণ ও দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ফলকে স্থান দেয়াসহ সার্বিকভাবে ফলের গুরুত্ব সম্পর্কে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন।
লেখক : সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট :www.moa.gov.bd